পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদ; ১৯৯৮
গঠন : ১৯৯৮ সনে জাতয়ি সংসদ কর্তৃক গৃহীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হবে : ক) চেয়ারম্যান; খ) ১২ জন উপজাতীয় সদস্য; গ) ৬ জন অ-উপজাতয়ি সদস্য; ঘ) ২ জন উপজাতীয় মহিলা সদস্য; ঙ) ১ জন অ-উপজাতীয় মহিলা সদস্য সহযোগে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণ পদাধিকার বলে এ পরিষদের সদস্য আঞ্চলিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ৫ জন চাকমা, ৩ জন মারমা, ২ জন ত্রিপুরা, ১ জন মুরং ও তনচৈংগা, ১ জন লুসাই, বোম, পাংখো, খুমী, চাক ও খেয়াং উপজাতি থেকে। অ-উপজাতয়ি সদস্যগণ প্রতিটি পার্বত্য জেলা থেকে দুজন করে নির্বাচিত হবেন। দুজন মহিলা সদস্যের একজন চাকমা এবং অন্যজন অন্যান্য উপজাতির মহিলাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। অ-উপজাতীয় মহিলা সদস্য তিনিটি জেলার অ-উপজাতীয় মহিলাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। চেয়অরম্যানসহ অন্যান্য সদস্য পার্বত্য জেলা পরিষদেসমূহের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ কতৃক নির্বাচিত হবেন। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হবেন একজন উপজাতীয়। তিনি অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে চেয়অরম্যানের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে উপজাতীয় সদস্যদের মধ্য থেকে একজন অস্থায়ী চেয়অরম্যান হিসেবে নির্বাচিত হবেন।
আঞ্চলিক পরিষদের কার্যাবলী : আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করবে। পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদসমূহ তত্ত্বাবধান এবং সমন্বয় সাধনও এর অন্যতহম কাজ। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান করবে আঞ্চলিক পরিষদ। পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃংখলা ও উন্নয়নের তত্ত্বাবধান এবং সমন্বয় সাধনও এর কাজ। তাছাড়া উপজাতীয় রীতিনীতি অনুসারে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও উপজাতীয় বিষয়ক বিরোধের নিষ্পত্তি, পার্বত্য জেলায় ভারী শিল্প স্থাপনের লাইসেন্স প্রদান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকার্য পরিচালনাও আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্ব। পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত। পরিষদ কাজের সহয়োতার জন্য প্রয়োজনবোধে কমিটি গঠন করতে পারবে। পরিষদের একজন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থাকবেন। তিনি সরকারের যুগ্ম-সচিবের পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তিনিও হবেন একজন উপজাতীয়। পরিষদের কার্য নির্বাহের জন্য পরিষদ সরকারের অনুমোদনক্রমে বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতে পারবে। এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপজাতয়ি হবেন।
আঞ্চলিক পরিষদের তহবিল : আঞ্চলিক পরিষদের স্বতন্ত্র তহবিল থাকবে। পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে প্রদেয় অর্থ, পরিষদের ওপর ন্যস্ত সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ, সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ঋণ ও অনুদান, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান, পরিষদ কর্তৃক প্রাপ্ত যেকোন অর্থ এ তহবিলে জমা হবে। বাজেটের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদের আয়-ব্যয় নির্বাহ করা হবে। যে লক্ষে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়েছে, তা পূরণকল্পে সরকারী প্রজ্ঞাপন দ্বারা আঞ্চলিক পরিষদ বিধি প্রণয়ন করতে পারবে। পরিষদের চেয়ারম্যান- সদস্যদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ, পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ, পরিষদের আদেশের বিরুদ্ধে আপীলের পদ্ধতি ও অন্যান্য বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
আইন প্রণয়নে আলোচনা : বাংলাদেশ সরকার আঞ্চলিক পরিষদ বা পার্বত্য জেলাসমূহ সম্পর্কে কোন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
সমালোচনা : আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইন বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে এ মর্মে যে-
১) কারো মতে, এ আইন বাংলাদেশ সংবিধানের পরিপন্থী। কেননা একক সংখ্যা গরিষ্ঠ একেকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে ৬৪টি জেলা পরিষদের ৩টির সমন্বয়ে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন অনেকটা রাষ্ট্রের মধ্যে আরো একটি রাষ্ট্র গঠনের সামিল বলে মনে করা হয়।
২) আঞ্চলিক পরিষদ সংগঠনের উপজাতি ও অ-উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে পার্থক্য রচনা করা হয়েছে, তা নিতান্ত অগণতান্ত্রিক। চেয়ারম্যানের পদ শুধুমাত্র উপজাতয়িদের জন্য সংরক্ষণ করা এবং উপজাতয়িদের জন্য আনুপাতিক হারে অধিক সদস্যপদ প্রদান করার বিষয়টি গণতন্ত্র সম্মত নয়।
৩) আঞ্চলিক পরিষদের হাতে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স দানের ক্ষমতা অগ্রহণযোগ্য হয় এজন্য যে, বৃহৎশিল্পের প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন বিষয় বটে।
৪) তহবিল গঠনের ব্যাপারে যে স্বাধীনতা আঞ্চলিক পরিষদকে দেয়া হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণ হয়ে ওঠতে পারে।
৫) আঞ্চলিক পরিষদ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জাতীয় পরিষদের আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা করার শর্তটি জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বকে আনেকটা খর্ব করে।
৬) এ আইনের মধ্যে বিদ্যমান মূল যে প্রেক্ষাপ্ট, অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল, তা ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালী জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিককে পরিণত করেছে হয়ত।
কাজেই 'নানা মুণির নানা মত' এ প্রবাদের আলোকে অনেকের ধারণা জন্মে যে, যেভাবে এবং যে শর্তে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়েছে, তা কতিপয় কারণে বিছিন্নতা প্রবণতা সহায়ক মাত্র।
সূত্র: বাংলাদেশের উপজাতিদের আইন- রামকান্ত সিংহ, ২০০৩
সৌজন্যে: প্যান লোকালাইজেশন প্রোজেক্ট