নিয়োগ নীতিতে কোটা পদ্ধতির ক্রমবিলোপ (উপজাতি কোটাসহ)
স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য একটি দক্ষ সিভিল সার্ভিসের মূলে নিহিত রয়েছে একটি সুচিন্তিত নিয়োগ নীতি। কেননা যদি নিয়োগ নীতি দুর্বল হয়, তবে তারপক্ষে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত প্রথম সারির সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই একটি বলিষ্ঠ নিয়োগ নীতি অন্য যেকোন বিষয়ের চেয়ে মেধাকেই সর্বাপেক্ষা অধিক প্রাধান্য দেয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে পারি যে, ১৯৯৩ সনের টুওয়ার্ডস বেটার গভর্ণমেন্ট ইন বাংলাদেশ (Toward Letter Government in Bangladesh, 1993) এর মতে, চাকরীতে নির্বাচনের ধরণ ও নিয়ম নীতির কারণে বাংলাদেশে মেধার বিবেচনা সংক্রান্ত গুরুত্ব ক্রমশ হারিয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের নিয়োগ নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট হল কোটা পদ্ধতির প্রাধান্য প্রদান- যা জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে এবং নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীর প্রার্থীদের প্রতি বিশেষ বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ বহুলাংশে একটি নির্ধারিত নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ পদ্ধতি (Closed Entry System) অনুসরণ করে চলছে, যেখানে প্রথমশ্রেণীর কর্মকর্তাদের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রারম্ভিক পর্যায়ে ২৯টি ক্যাডার ও বিভিন্ন সার্ভিসে সরাসরি নিয়োগ করা হয়। অবশ্য সহায়ক স্টাফদের মধ্য থেকে প্রথমশ্রেণীর পদে পদোন্নতির ব্যাপারে কিছুটা সীমিত সুযোগ রয়েছে। আর ১৯৮১ সনে নিয়োগ বিধি অনুযায়ী ক্যাডার পদগুলোর মধ্যে রয়েছে সাধারণ প্রশাসন, কার্যাভিত্তিক ও পেশাদার পদসমূহ। সরকারী কর্মকমিশন (পিএসসি) বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত সুযোগের সমতার ভিত্তিতে সরাসরি নিয়োগের কাজ পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে তুলনামূলক দৃষ্টিতে মধ্য ও উচ্চ ব্যব্সথাপনা পর্যায়ে এবং বিশেষ বিশেষ পদের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ বাইরে থেকে পূরণ করা যেতে পারে।
দৃশ্যত কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে বাংলাদেশ সর্বাপর জেলা ও অন্যান্য কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করে। কিন্তু সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিককের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।" আবার ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "কেবল ধর্ম গোষ্ঠী বর্ণ, নারী পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদান করিবে না"। অনুচ্ছেদে ২৮(৪) এ উল্লেখ করা হয়েছে, "নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছু রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবেনা।"
উপরের অনুচ্ছেদগুলো থেকে এটি পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা হয় যে, নারী ও নাগরিকদের পশ্চাৎপদ অংশের অগ্রতির জন্য প্রণীত বিশেষ ব্যবস্থাদি সংবিধানের বিধানসমূহের সংগে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু জেলা ও জন্মস্থানের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত অন্যান্য কোটাগুলো সংবিধানের বিদানসমূহের সংগে খুব একটা সংগতিপূর্ণ নয়। তাসত্বেও জন্মস্থান ভিত্তিক জেলা কোটার বৈশস্যমূলক নীতি চালু রয়েছে। এ কোটা সরকারী চাকরীতে মেধাবী কর্মকর্তাদের প্রবেশকে অন্যকাঙক্ষিতভাবে ব্যাহত করা ছাড়াও নিয়োগের ব্যাপারটিকে নানাভাবে জটিল করে তুলেছে। অন্তবর্তীকালীন একটি নিয়োগ নীতি হিসেবে প্রচলন প্রক্রিয়া শুরু হলেও এই কোটা পদ্ধতি এখনো বলবৎ রয়েছে এবং মেধা কোটা হতমধ্যে শতকরা ২০ ভাগ থেকে শতকরা ৪৫ ভাগে উন্নীত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এখন যে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তহলে-
কোটার ধরণ |
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য (%) |
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য (%) |
মেধা |
৪৫ |
-- |
অনাথ ও প্রতিবন্ধী |
-- |
১০ |
মুক্তিযোদ্ধা |
৩০ |
৩০ |
মহিলা |
১০ |
১৫ |
উপজাতীয় |
৫ |
৫ |
আনসার ও ভিডিপি সদস্য |
-- |
১০ |
সাধারণ |
১০ |
৩০ |
মোট = |
১০০ |
১০০ |
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হল যে, অল্প সংখ্যক পদে লোক নিয়োগ করা হলে সাধারণত যে অসুবিধা ঘটে, তাহল ছোট ছোট বিভাগ ও জেলাগুলো পদলাভ থেকে বঞ্চিত হয়্ এর একমাত্র কারণ হল উপযুক্ত মেধা বণ্টন করা হয়্ উভয় ক্ষেত্রে বড় জেলাগুলো বেশীর ভাগ পদ পেয়ে যায় এবং ছোট জেলাগুলো কার্যত বঞ্চিত থাকে। অথচ পরিহাসের বিষয় হল, যদিও সকল জেলা থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত পদপ্রাপ্তির বিষয়টি সুগম করার লক্ষে ভৌগলিক কোটার প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘটছে তার বিপরীত প্রক্রিয়া। [সূত্র : বাংলাদেশের লোক প্রশাসন; ফিরোজা বেগম]।
সূত্র: বাংলাদেশের উপজাতিদের আইন- রামকান্ত সিংহ, ২০০৩
সৌজন্যে: প্যান লোকালাইজেশন প্রোজেক্ট