আদিবাসীদের জোতজমা হন্তান্তরের পর্যালোচনা বা সমালোচনা
ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, বৃটিশ শাসনামলে ১৮৬০ সনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেলায় পরিণত করা হয়। বৃটিশদের আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি বহির্ভূত এলাকা এবং এ কারণেই বৃটিশরা এক আইন প্রণয়ন করে, যার নাম ছিল "পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০"। উহার পরবর্তীতে ঐ আইনটি পরিবর্তন করে "বহির্ভূত এলাকা আইন ১৯০০" রাখা হয়েছিল। বস্তুত উক্ত আইনে অত্র এলাকায় অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের বসতী স্থাপন নিষিধ্ধ করা ছিল- কারণ এটি ছিল সম্পূর্ণরূপে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বাহিরে। এমনকি ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনেও এতদ অঞ্চলকে পৃথক শাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়- যা ১৯৫০ সনের প্রজাস্বত্ব আইনেও উহাই বহাল ছিল।
অতপর ভারতবর্ষ বিভক্তির পরে পাকিস্তান শাসনামলেও ১৯৫৬ সনের শাসনন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি 'পৃথক শাসতি অঞ্চল' হিসেবে ঘোষণা করা হয়্ অতপর ১৯৬২ সনে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রে বর্ণিত পূর্বে ভারতীয় শাসনতন্ত্রে উল্লিখিত ১৯৩৫ সনের "পৃথক শাস্তি অঞ্চল" শব্দের পরিবর্তে সংবিধানে "উপজাতীয় অঞ্চল" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বেশকিছু উপজাতীয় তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেছিল ঠিক, তবে চাকমা রাজা ত্রিদির রায় চৌধুরী নিজে পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। যাহোক ১৯৭২ সনে প্রবর্তিত সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শান্তি অঞ্চলের সংজ্ঞা বিলুপ্ত করা হলে এতে পার্বত্যবাসীদের জাতীয় অস্তিত্বে চরমভাবে ঘা লাগে।
১৯৭৩ সনের শেষার্ধে শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটিতে এক জনসভায় ঘোষণা দেন, নারায়ণ "উপজাতীয় নয়, আমরা সকলেই বাঙালি"। উপজাতয়িরা এ ঘোষণায় খুশী হতে পারেনি। বিধায় পরবর্তীতে মানবেন্দ্র লারমা এম.পি. এক বক্তব্যে শেখ সাহেবের উক্ত ঘোষণার বিরুদ্ধে জোরালো কথায় বলেন, "উপজাতীয়রা বাঙালি নয়"। তদমোতাবেক তিনি গণভবনে শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করত তাদের স্বকীয় পৃথক সত্তার দাবীসহ স্বায়ত্বশাসনের দাবী উত্থাপন করলে শেখ মুজিব তা ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেন। এরপর বিভিন্ন সামবেশ আয়োজনের মাধ্যমে আরো কতিপয় দাবী প্রাপ্তির ব্যঅপারে অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবার চরম গ্লানির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের উপজাতীয়দের ওপর কিছুটা দমন নীতি চালানোর উপক্রম হলে উহার প্রতিকার নেয়ার উদ্দেশে চাকমা নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এম.পি. দৃঢ়ভাবে শান্তিবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়।
অবশেষে জিয়াউর রহমান পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের বসতী স্থাপন গড়নের ব্যাপক ব্যবস্তা নেন। জ্ঞাতব্য যে, তখন উপজাতি-আদিবাসীগণ তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যময় ও সংস্কৃতিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে গিয়ে মারাত্মকভাবে নিরক্ষরতার অভিশাপে মির্জ্জিত হয়ে পড়ে। সর্বপরি তারা সরল প্রকৃতির হওয়ায় প্রতিবেশী শিক্ষিত ও চতুর প্রতিবেশীগণ যাতে প্রতারণার অজুহাতে তাদের সহায় সম্ভল উপযোগ্য সম্পত্তি বা জমিজমা কোনও কায়দায় কুক্ষীগত করতে না পারে তদ্দেশে ১৯৫০ সনের রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারার আওতায় কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত করা হয়েছে। এভাবে আদিবাসীদের (Aboriginals) স্বার্থ, অধিকার ও জোতজমা হস্তান্তরজনিত আইনগত বিধিবিধান উপযুক্তভাবে সংরক্ষিত করা হয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশের উপজাতিদের আইন- রামকান্ত সিংহ, ২০০৩
সৌজন্যে: প্যান লোকালাইজেশন প্রোজেক্ট