সরকারী চাকুরীতে কোটা পদ্ধতি (উপজাতি কোটাসহ)

 

    বাংলাদেশের সরকারী চাকরীতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত কোটা পদ্ধতি হচ্ছে, মেধা সম্পন্ন প্রার্থী, এতিমখানার নিবাসী ও প্রতিবন্ধী, জনসংখ্যার ভিত্তিতে মহিলা, মুক্তিযোদ্ধা/সাধারণ প্রার্থীদের মধ্য হতে সুনির্দিষ্ট শতকরা হারে প্রার্থী নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিবিধান কার্যকর রাখা। দেশের বার্সিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ জনসংখ্যাকে উৎপাদন কার্যক্রম ও সেবামুখী কাজে উৎসাহ প্রদান এবং চাকরীতে নিয়োগ করণে পশ্চাৎপদ এলাকার জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আনয়নই কোটাপদ্ধতি বহাল রাখার মূল লক্ষ। সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে সরকারী চাকরীতে প্রার্থী নির্বাচনে সাংবিধানিক দিক নির্দেশনা বিষয়গুলো এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা হল।

    সংবিধানের তৃতীয় ভাগে "মৌলিক অধিকার" বিষয়ক অংশে অনুচ্ছেদে সরকারী নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা সংক্রান্ত বিধানটি বর্ণনা করা হয়েছে, যার উদ্ধৃতাংশ নিম্নরূপ-

    ২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।

    ২৯(২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগিরক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষশ্য প্রদর্শন করা যাইবেনা।

    ২৯(৩) এই অনুচ্ছেদের কিছুই;

(ক) নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে,

(খ) কোন ধর্মীয় বা উপসম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তির জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান সম্বলিত যেকোন আইন কার্যকর করা হইতে

(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যেকোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।

    যাহোক সংবিধানের ২৯(৩) ক অনুচ্ছেদে "নাগরিকদের কোন অনগ্রসর অংশের" কথা বলা হয়েছে, দেশের কোন ভৌগোলিক অংশের জন্য নয়। ফলে সরকারী চাকরীর শূন্যপদ জেলা কোটায় ভাগ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা যথার্থই পর্যালোচনা করার দাবী রাখে। এখানে আমরা স্পষ্টত অবলোকন করছি  য, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ১০-০৩-৯৭ইং তারিখের সম(বিধি-১)এস-৮/৯৫(অংশ-২)-৫৬(৫০০)নং সর্বশেষ নির্দেশ মোতাবেক কোটা পদ্ধতিটি নিম্নরূপে পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে-

 

ক্রমিক নং

বিভিন্ন ধরনের কোটা

১ম ও ২য় শ্রেণীর পদে শতকরা হার

৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর পদে শতকরা হার

১.

মেধাকোটা (জেলা কোটা বহির্ভূত)

৪৫%

--

২.

এতিমখানা নিবাসী ও প্রতিবন্ধী (জেলাকোটা বহির্ভুত)

--

১০%

৩.

জেলাকোটা (জনসংখ্যার ভিত্তিতে)

   
 

(১) মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা না পাওয়া গেলে মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র/কন্যা

৩০%

৩০%

 

(খ) মহিলা কোটা

১০%

১৫%

 

(গ) উপজাতীয় কোটা

৫%

৫%

 

(খ) আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের কোটা

--

১০%

 

(ক) অবশিষ্ট (জেলার সাধারণ প্রার্থীদের জন্য)

১০%

৩০%

 

মোট =

১০০%

১০০%

 

    বাস্তব অবস্থা দৃষ্টে বলতে হয় যে, দীর্ঘকাল ধরে সিভিল ব্যবস্থায় জেলাকোটা পদ্ধতির সুবাদে উৎকৃষ্টদের ডিঙ্গিয়ে নিম্নমেধাসম্পন্ন লোকেরা সহজভাবে নিয়োগ লাভের সুবিধা পাচ্ছে। কর্মজীবনে মেধা ভিত্তিক উন্নতির জন্য এ সূচনা প্রায়শ অশুভ হতে বাধ্য। সরকারী কর্মকমিশন তাদের বার্ষিক রিপোর্টগুলোতে মেধা নীতির অনুকূলে কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য বার বার সুপারিশ করছে। কিন্তু তাদের সুপারিশের ব্যাপারে এখনও কোন কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।

    বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের দক্ষতা বা কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের (পিএআরসি) অভিমত হচ্ছে, শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর এখন সময় হয়ে এসেছে। তদ্ব্যতীত অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক পদে একটা নির্ধারিত সময়ের জন্য মহিলা এবং চশ্চাৎপদ উপজাতীয় শ্রেণীর লোকদের কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ করা যেতে পারে। ইতমধ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রে কোটা যাতে পুরপুরি বিলোপ করা যায়, সেজন্য তাদের সার্বিক অগ্রগতি অর্জনের অবাধ সুযোগ করে দিতে হবে। সমাজের সকল শ্রেণীর জন্য সুযোগের সমতা আনয়ন এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটানোর লক্ষে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা হিসেবে অনেকে ধারণা করে থাকে। সরকারী কর্ম কমিশন কর্তৃক নিয়োগের ক্ষেত্রে আরেকটা অন্যতম গুরুতর সমস্যা হল, বিপুল সংখ্যক প্রার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে, যাদের জন্য সারাদেশে বহু সংখ্যক পরীক্ষা হলের ব্যবস্থা করতে হয়। এভাবে বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করার কারণে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়না। তাছাড়া অনিয়মিতভাবে পরীক্ষা নেয়ার কারণেও একের পর সমস্যা আরো বাড়ে। একারণে পরীক্ষকদের মানের বিষয়টি ছাড়াও উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নম্বরের অবশ্যম্ভাবী তারতম্য দেখা যায়। তাছাড়া একই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বোর্ডে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। তাতে পরীক্ষার ফলাফলে ব্যাপক পার্থক্য হবার প্রচুর সুযোগ থেকে যায়। এমতাবস্থায় যথারীতি মেধার মূল্যায়ন এবং প্রার্থীদের উপযুক্ততা যাচায়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব নয়, বরং দৃষ্টিভংগীর পার্থক্য ও পরীক্ষা মানের বিভিন্নতার কারণে বস্তুনিষ্ঠতা ব্যাহত হয়।

    নিয়োগদানের ক্ষেত্রে যে সুদীর্ঘ সময় নেয়া হয় তা নিয়োগ প্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুতর সমস্যা বটে। নিয়োগ দানের বর্তমান পদ্ধতিটি অতিরিক্ত ভারাক্রান্ত থাকে এবং বিভিন্ন চাকরীর নিজস্ব চাহিদাগুলোর ব্যাপারে তা আশানুরূপ সংবেদনশীল হতে পারেনা। যেসব নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সেসব নিয়োগের সময় এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

    সরকারী খাতের সংস্থাগুলোকে প্রচলিত নিয়োগ নির্দেশিকা অনুসারে তাদের কর্মচারী নিয়োগের স্বাধীনতা দেয়া যেতে পারে। তবে আরো মৌলিক পরিবর্তনের জন্য সরকারী ইউনিটগুলোর কাঠামো কিভাবে পরিবর্তন করা হবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সরকার যদি ইংলন্ডের মত "সংস্থা প্রধান উদ্যোগ" (agency head approach) বেছে নেন, তাহলে তাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রধানগণকে মধ্য পর্যায়ের কর্মচারী নিয়োগসহ কর্মচারী সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতার সুযোগ দিতে হবে। ইংলন্ড, নিউজিলান্ড ও সিংগাপুরে সংস্থা প্রধানগণকে ইতমধ্যেই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজারের সংগে সংগতিপূর্ণ বেতন প্রদানের মাধ্যমে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী নিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে। অবশ্যই এ পদ্ধতিটি বিবেচনার দাবী রাখে। কারণ এতে প্রকাশ্য বিজ্ঞাপনের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয় এবং নিয়োগের জন্য সর্বচ্চ মেধাসম্পন্ন অসংখ্য প্রার্থী পাওয়া যায়। চাকরীর জন্য সর্বোত্তম ব্যক্তিটিকে পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত পদোন্নতি প্রথাটি অত্যন্ত অনমনীয় রূপধারণ করে। প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও প্রশিক্ষকদের উদাহরণ থেকে বুঝা যায়, তাদেরকে এসব প্রতিষ্ঠানে যেতে কিভাবে বাধ্য করা হয় এবং সে কাজের জন্য তারা কতটা অনুপযুক্ত ও উপযুক্ত ইত্যাদি যাচাই করা যায়। উন্মুক্ত নিয়োগ এ পরিস্থিতির প্রতিকার করতে পারে।

    আজকের এ বিশ্বায়নের যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল, জটিল ও পরস্পর নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা যেকোন সরকারের পক্ষে এক গুরুদায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যঅলেঞ্জ হল বিশেষ ব্যবস্থাপনায় জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী অপরিহার্য জনবল নিয়োগ করা। তাই নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ক্যাডার ভিত্তিক "নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ" পদ্ধতি প্রয়োজনীয় দক্ষ পেশাজীবীদের প্রাপ্যতাকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে। বাংলাদেশের দুর্বল আমলাতন্ত্রের প্রতিকারে "পার্শ্বিক প্রবেশ" (lateral entry) পদ্ধতি; অর্থাৎ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ভিন্ন ক্যাডারে তারপদের সমান্তরাল যেকোন পদে নিয়োগ দানের পদ্ধতিটি একটা ভাল উপায় হতে পারে বলে মনে করা হয় [সূত্র : বাংলাদেশের লোক প্রশাসন; ফিরোজা বেগম]।

 

সূত্র: বাংলাদেশের উপজাতিদের আইন- রামকান্ত সিংহ, ২০০৩

 

 

সৌজন্যে: প্যান লোকালাইজেশন প্রোজেক্ট